'বাউল' একটি মৃত্তিকাগন্ধী শব্দ, যার ভেতরে আবহমান গ্রামবাংলা তথা চিরায়ত লোকজীবনের প্রাণ-স্পন্দন শোনা যায়।
প্রথমে বাউল শব্দ বিষয়ে পণ্ডিতদের অভিমত শোনা যাক।
"বাংলার বাউল ও বাউল গান" গ্রন্থে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন,"মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'চৈতন্য চরিতামৃত'গ্রন্থে এই 'বাউল' শব্দটির বহু ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়'-এ প্রথম আমরা এই শব্দটির ব্যবহার দেখি। 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়'-এর যে কয়খানি পুঁথি মিলাইয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উহার সম্পাদনা করিয়াছিল, তাহার একটি পুঁথিতে যে অতিরিক্ত অংশ পাওয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে এই শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়।
...'মুকুল (ত) মাথার চুল নাংটা যেন বাউল... মনে হয়, সংস্কৃত "বাতুল" (অর্থাৎ উন্মাদ) শব্দের প্রাকৃত রূপ লইয়া 'বাউল 'শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করিয়াছে। 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়,'চৈতন্য চরিতামৃত' ও রাগাত্মিকা-পদে এই 'বাতুল'শব্দেরই প্রাকৃত রূপ হিসাবে 'বাউল' শব্দটি আমরা পাইয়াছি।” (পৃ. ৩-৪৬)
"চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর "বঙ্গবীণা'র ৪৫১ পৃষ্ঠায় বলেন,-
"একটি বিশেষ ধর্মের লোকদিগকে বাউল বলে।... যে সম্প্রদায় দেহের স্নায়বিক শক্তির সঞ্চার সাধন করিবার সাধনা করেন, তাহারা বাউল। কেহ বলেন, বায়ু মানে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শ্বাস প্রশ্বাস অর্থ জীবন ধারণ এবং তাহা সংরোধ করিয়া দীর্ঘ জীবন লাভ করিবার সাধনা করেন যাহারা, তাহারা বাউল।... যাহাদের আচরণ সাধারণের তুল্য নহে, লোকে তাঁহাদিগকে পাগল বা বাতুল বলে, এরূপ সাধারণ সমাজ বহির্ভূত আচার ব্যবহার সম্পন্ন ধর্ম সম্প্রদায় বাউল।" (আনোয়ারুল, পৃ. ৪০-৪১)
ড. আহমদ শরীফ 'বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য' গ্রন্থে বাউল শব্দের উৎপত্তি বিষয়ে অনেকের অভিমত সন্নিবেশিত করেছেন-
"ডক্টর ব্রজেন্দ্রনাথ শীল 'বাউল' শব্দটি 'আউল' শব্দজ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে 'আউল'আরবী 'আউলিয়া' (ওলীর বহুবচন) সম্ভূত। ডক্টর সৈয়দ আবদুল হালিমের মতে আউল' শব্দটি 'আউয়াল' শব্দজ।... এ কয়টি ব্যাখ্যার কোনটাই উড়িয়ে দেবার মত নয়। তবে 'ব্যাকুল' বা 'বাতুর' থেকেই 'বাউল' নামের উদ্ভব বলে অনুমান করা সম্ভবপর। আমাদের এ অনুমানের পক্ষে একটি যুক্তি এই যে, সমাজের উঁচুস্তরে বাউলেরা কোনোকালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদার আসন পায় নি। তাই মনে হয়, 'ব্যাকুর' (ভাবোন্মত্ত) কিংবা "বাতুল' (অপদার্থ) অর্থে উপহাসস্থলে তাদের এই নামকরণ হয়েছে। আর 'আউয়াল' থেকে 'আউল' শব্দের উদ্ভবের সম্ভাব্যতাও সহজে অস্বীকার করা যায় না। আবার বাউল মতের আদি প্রবর্তক বলে খ্যাত ব্যক্তির নামটিও আউলচাঁদ।...
সম্প্রতি ডক্টর এস.এম. লুৎফুর রহমান তাঁর 'বাউল শব্দের উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা' নামের প্রবন্ধে' 'বাউল' নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নতুন তথ্য দান করেছেন। তিনি অবহঠট রচনায় ও চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত বাজিল, বাজুল, বাজির, বাজ্জিল শব্দগুলোকে বাউল শব্দের পূর্বরূপ বলে নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে বস্ত্রী-বজ্জির-বাজির-বজ্জিল-বাজিল-বাজুল-বাউল। অবশ্য বজ্রযানী বৌদ্ধ যদি 'বজ্রকুল'নামে অভিহিত হত বলে অনুমান করা সম্ভব হয়, তাহলে 'বজ্রকুল' থেকে 'বাউল' হওয়া আরো সহজ। যেমন বজ্রকুল-বজ্জউর-বাজুল-বাউল। যা হোক, বাউল যে বজ্রযানী নির্দেশক, সে-সম্পর্কে আমরা নিঃসংশয় হতে পারি। (পৃ. ৩৭৬)
শ্রীভূদেব চৌধুরী তাঁর 'বাংলা সহিত্যের ইতিকথা, ১ম পর্যায়' গ্রন্থে একজন বিদ্বান গবেষকের মতামত যুক্ত করেছেন- "পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন এ-সম্বন্ধে বলেছেন,-"বহু শতাব্দী ধরিয়া জাতি-পঙক্তিবহির্ভূত নিরক্ষর একদল সাধক শাস্ত্রভারমুক্ত মানবধর্মই সাধনা করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহারা মুক্তপুরুষ তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই...।" (পৃ. ৩৮৯)
এগুলো ছাড়াও বাউল শব্দ বিষয়ে বিদ্বানেরা আরো নানাবিধ মতামত লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
শুধু শব্দ বিষয়েই নয়, পণ্ডিতদের লেখায় বাউল সম্প্রদায়ের অনেক বিচিত্র বৈশিষ্ট্যও প্রতিভাত হয়েছে। কয়েকটি চয়িত হল,
(১) "বাউল একটি ধর্ম-সম্প্রদায়। বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন-পদ্ধতি আছে, সাধক-জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাহাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গী আছে, এই সমস্তই তাহাদের গানে ব্যক্ত হইয়াছে। এই সম্প্রদায়ের সাধকগণের তত্ত্ব-দর্শন ও সাধনা-সংবলিত গানই প্রকৃত বাউল-গান।...এই গানই তাহাদের ভাব ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম,আত্মপ্রকাশের একমাত্র পথ। তাহাদের নিজস্ব বৈঠকে প্রায়ই প্রশ্ন ও উত্তরের (সওয়াল ও জবাবের) ভঙ্গীতে গান গীত হয়। সাধারণত: এই বৈঠকে গুরুস্থানীয় ব্যক্তিদের বা উচ্চাঙ্গের সাধকদের রচিত গান ('মহাজন-পদ") গীত হয়, কোনো কোনো সময় নিজেদের রচিত গানও থাকে।"
(উপেন্দ্র, পৃ. ১০৩-১০৪)
(২) "বাউলদের একটা বৈশিষ্ট্য এরা নরসুন্দরদের আদৌ ধার ধারে না। ক্ষৌরকার্য এরা আদৌ করে না। সহজভাবে এরা জীবনযাত্রার পক্ষপাতী বলেই কেশ, গুম্ফ এবং শ্মশ্রুর সংস্কারের পক্ষপাতী নয়।...এরা প্রধানতঃ মনের মানুষ রূপেই ঈশ্বরকে সাধনা করে।" (মনসুর, পঞ্চম, পৃ.২৫০)
(৩) "মুসলমান-ফকির ও হিন্দু-বাউলরা তাহাদের স্ব স্ব সমাজের গণ্ডী হইতে নানা কারণে দূরে অবস্থান করিয়া নির্দিষ্ট আস্তানা বা আখড়াতে সমবেত হইয়া তাহাদের ধর্মের তত্ত্ব ও নিগূঢ় সাধন-সংকেত মূলক গান গাহিয়া তাহাদের মনোভাব ব্যক্ত করিত।" (উপেন্দ্র, পৃ. ১৩১)
(৪) আখড়া সম্পর্কে ড. ওয়াকিল আহমদ 'বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত' গ্রন্থে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন-
"গান করা বাউলদের সাধনার অঙ্গ।... বাউল প্রভাবিত অঞ্চলে নানা আখড়া ছিল। বাউল-গুরুর জন্মভূমি অথবা সাধন-ক্ষেত্রকে ভক্ত শিষ্যরা আখড়ায় পরিণত করে। বাউলরা কোন বিশেষ দিন উপলক্ষে আখড়ায় সমবেত হয়ে নাচ-গান করে ও মত বিনিময় করে কিছুকাল অতিবাহিত করে।... কেবল নাচ-গান করে সময় কাটাবার জন্য নয়, এ সময় তাদের মধ্যে তত্ত্ব আলোচনা, ভাবের আদান-প্রদান ও মতামত প্রচারের কাজও সম্পন্ন হয়। যাদের লিখিত শাস্ত্র-গ্রন্থ নেই, যাদের ধর্ম তত্ত্বাশ্রয়ী, সাধনা দেহ-কেন্দ্রিক, যারা গোপন সাধনার কথা রূপকের ভাষায় গানে প্রকাশ করে, তারা আখড়ার মেলাকে সাধারণ মেলা হিসাবে দেখে না। মিলন-কেন্দ্র হিসাবেই দেখে থাকে। যদিও বাউলরা প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধী ছিল, তথাপি তারা বৈষ্ণবদের আখড়া-পদ্ধতি পরিত্যাগ করে নি। কেননা ধর্মচর্চার ও ধর্মপ্রচারের জন্য এগুলোর বাস্তবে উপযোগিতা ছিল।” (পৃ. ৪৩২-৪৩৩)
(৫) এ গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায়-
"বাউলরা গুরুবাদী সম্প্রদায়। গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল হতে হয়।... মৌখিক ধারার গুপ্ত তত্ত্বজ্ঞান গুরু ছাড়া জানার অন্য উপায় নেই। তাছাড়া দেহতাত্ত্বিক জটিল সাধন-প্রক্রিয়া গুরুর সাক্ষাৎ সাহায্য বা নির্দেশ ব্যতীত সম্পন্ন হয় না। উভয় কারণে বাউলদের কাছে গুরুর স্থান অতি উচ্চে। গুরু 'সিদ্ধ পুরুষ' বা 'পূর্ণ বাউল'।...গুরু ধরেই বাউল অধ্যাত্ম সাধনা, পরমাত্মার অন্বেষণ এবং জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার সংগ্রাম করে। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারীর সংসর্গ, এবং যোগ-সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী-সম্ভোগ বাউলধর্মে স্বীকৃতি পায়।... বাউলরা অধ্যাত্ম প্রেমাস্বাদনের জন্য দেহজ প্রেমকে গ্রহণ করে যৌনাচরণে স্বাধীনতা (sex freedom) নিয়ে আসে।... এক্ষেত্রে বাউলরা দেহ-সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয়ভাবে বৈধ করে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ও নৈতিক-চেতনার বিরোধিতা করে। ডিভাইন লাভ বা অধ্যাত্মপ্রেমের জন্য দেহ-প্রেম; স্বয়ং গুরু এ-প্রেমের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে গুরুর সাক্ষাতে মিলন-ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সুতরাং যৌন ব্যাপারে কোন পাপবোধ বাউলদের ছিল না।... বাউলরা ব্যভিচারমুক্ত যৌনাচার সমর্থন করত। নারী পণ্য নয়, পুতুলও নয়; সাধন সঙ্গিনী হিসাবে নারীকে গ্রহণ করে তারা নারীকে সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে এবং নারী ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে।" (পৃ. ৪৩৩-৪৩৫)
(৬) ড. আহমদ শরীফ তাঁর 'সাহিত্য তত্ত্ব ও বাঙলা সাহিত্য' গ্রন্থে বলেন-
বাউলেরা রাগপন্থী। কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। ইন্দ্রিয় নিরোধ, বিষয় ত্যাগ, কিংবা বৈরাগ্য এদের লক্ষ্য নয়। তবু প্রাচীন ভারতিক ঐতিহ্য প্রভাবে মুনি, আজীবক, ভিক্ষু, সাধু, সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব, বৈরাগী প্রভৃতির মত বাউলেও ভিক্ষাজীবী বৈরাগী আছে। সে হিসেবে বাউল দুই প্রকারঃ গৃহী ও বৈরাগী। বর্তমানে এরা বহু উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত। হযরতী, গোবরাই, পাগল নাথী, খুশী বিশ্বাসী, সাহেব ধনী, জিকির, ফকির, বাউল, আউল, কর্তভজা, সাই, ন্যাড়া, বলরামী, শম্ভুচাঁদী, রামবল্লভী প্রভৃতি নাম থেকে তাদের সম্প্রদায়ের প্রবর্তকের নাম ও সাধন পন্থার আভাস পাওয়া যায়।
এদের সম্প্রদায়ের গুরু পরম্পরার ও ধর্ম-দর্শনের কোনো নির্ধারিত ইতিহাস বা শাস্ত্রগ্রন্থ নেই। তাই এ সব মতের উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতির খবর পাওয়া দুষ্কর। বিশেষ করে বাউলেরা প্রায় অশিক্ষিত, তাদের শ্রুতি-স্মৃতির উপর তেমন নির্ভর করা চলে না। বাউল সাধনার মর্মকথা বাউল কবির ভাষায় এরূপ-
সখি গো জন্মমৃত্যু যাঁহার নাই।
তাঁহার সঙ্গে প্রেম গো চাই ।
এবং
উপাসনা নাইগো তার দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থব্রত যার জন্য -
এ দেহে তার সব মিলে।
বাউল কবিদের মধ্যে: লালন শাহ, শেখ মদন, গঙ্গারাম, পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ, পদ্মালোচন (পোদো) যাদু, দুদ্দু, পাঁচু, চন্ডী, গোঁসাই, রশীদ, হাউড়ে গোঁসাই, গোলাপ গোঁসাই, চণ্ডীদাস গোঁসাই, ফুলবাসুদ্দিন, ঈশান, বাখেরা শাহ, এরফান শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, মিয়া ধন, শীতলাঙ শাহ, আতর চাঁদ, তিনু, শ্রীনাথ, শেখ কিনু প্রভৃতি জনপ্রিয়। (পৃ. ২৭৫)
(৭) ড. ওয়াকিল আহমদ তাঁর 'বাংলা লোক সংগীতের ধারা' গ্রন্থে বাউল গান আলোচনাকালে ড. মুহম্মদ এনামুল হক এর একটি উক্তি চয়ন করেছেন-
"বাউলরা অজ্ঞাত মর্মের অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করিতে গিয়া, হৃদ-বিহারী অচিন পাখিকে ধরিতে চেষ্টা করিয়া, অন্তরতম মনের মানুষকে মর্ম দিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়া, দরদী সাঁই-এর প্রেমময় পরশ লাভ করিতে ইচ্ছা করিয়া যে পথ অবলম্বন করিয়াছিল, তাহা বঙ্গীয় চিন্তা-জগতের সম্পূর্ণ স্বাধীন পথ। এ পথ বাঙালীর নিজস্ব পথ; এ পথ চলিতে চলিতে বাঙালী মায়ের ভিজা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়।...তাহাদের ভাবজাগতিক বিজয়-অভিযানের সম্মুখে কোরান, পুরাণ, বেদ, বাইবেল দাঁড়াইতে পারে নাই; মুহম্মদ, যীশু, কৃষ্ণ, চৈতন্য পথ ছাড়িয়া দিয়াছেন।” (পৃ. ৩৮০)
এ গ্রন্থে বাউল বিষয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি উক্তি রয়েছে- "বাউল মতবাদের বিকাশ হয় সামন্ত সমাজের শাসক শ্রেণীর প্রতিকূল মতবাদ হিসাবেই। বাউলরা প্রচলিত ধর্ম, জাতি বা বর্ণবৈষম্য, দেব-দেবী, পূজা-আচার, নামাজ-রোজা, মন্দির-মসজিদ কণ্টকিত সামন্ত সমাজের ধ্যান-ধারণাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতেন, এবং সেই ভাবধারাতেই আপ্লুত তাঁদের 'মনের মানুষ' এক নতুন মানবতাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সামন্ত সমাজে নিপীড়িত জনমানসে তাই সেই মানুষটি আসন পাততে পেরেছিল। সমাজের অতি দরিদ্র ভূমিহীন নিঃস্ব চাষী ও তথাকথিত নিম্নজাতি থেকেই বাউলরা এসেছিলেন।
... বাউল দর্শন মানবমুখী, ইহজীবনমুখী, তবু কেন তারা বিবাগী, কেন নিজেরা বলে, 'আমরা পাখির জাত।' তার কারণ আচার-বিচারের প্রহরী-ঘেরা বর্ণহিন্দুর সমাজের অচলায়তনে মুক্তমতি বাউলদের বাসা বাঁধবার কোনো সুযোগ ছিল না। 'এই মুক্ত ডানা' পাখির জাত ছিল সামন্ততন্ত্রী শেকলে বাঁধা মেহনতকারী মানুষের মুক্তি-কামনারই প্রতীক ও প্রতিনিধি।" (পৃ. ৩৮১)
এ দেশের হিন্দু মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে বাউল শব্দ ব্যবহৃত হয় ব্যাপকতর অর্থে বিশেষ ব্যঞ্জনায়। সংসারে থেকেও যাঁরা অধ্যাত্ম চিন্তায় বিভোর যাঁদের মন-মনন সদা সর্বদা স্রষ্টামুখী, মরমি রাগিনী যাঁদের হৃদয়বীণার একমাত্র সুর, তারাই বাউল শ্রেণির অন্তর্গত। অর্থাৎ তাঁদেরকেই বলা হয় বাউল। প্রখ্যাত বাউল গবেষক ডক্টর উপেন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার সকল মরমি সাধকই বাউল। তবে তিনি অকপটে একটা কথা বলে গেছেন তাহল-পশ্চিম বঙ্গের অমুসলমান ভাব-সাধকেরাই প্রধানত বাউল। তাঁর কথায়, "সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুজাতির এই সব সাধককে সাধারণত: বাউল বলা হয়। উত্তরবঙ্গেও ইহারা ঐ নামে পরিচিত।" (পৃ. ৫৩)
আমাদের মতে, মরমি অনুধ্যানে নিবিড় সংসক্তির কারণে কাউকে বাউল অভিধায় বিশেষিত করা যায় না। "অবশ্য একথা সত্যি যে, সব আধ্যাত্মিক সাধকই আসলে আউলা ঝাউলা, উদাসী ত্যাগী ও এশকে দেওয়ানা। এ অর্থে তাঁরা প্রেমের পাগল বা খ্যাপা বাউল"। (রিয়াজুল, পাঞ্জু, পৃ. ২৬)
জগতের অপার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ তথা কর্ম কোলাহল ছেড়ে তাঁদের ভাবুক অন্তঃকরণ প্রেমের জন্য আকুল ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ নিরিখে জগতের সব মরমি সাধককেই বাউল বলা যায়।
(৮) বাউল তত্ত্বনির্ভর বাউলগান সাহিত্য হিসেবেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে দীপ্র। এককথায় চিরোজ্জ্বল। এ কথা সকল পণ্ডিতজন কর্তৃক স্বীকৃত। আমাদের বক্তব্যের পরিপোষণে এবার আমরা কিছু মন্তব্য চয়ন করবো।
'সাহিত্য তত্ত্ব ও বাংলা সাহিত্য' গ্রন্থে ড. আহমদ শরীফ বলেন-
বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন, সাধনসঙ্গীত ও ভজন, গান ও গীতিকবিতা। তথাপি ভাষায়, আঙ্গিকে ও ভঙ্গিতে এগুলো আমাদের লোকসাহিত্যেরই অন্তর্গত। ... ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে। এরা রুমী-হাফিজের সগোত্র সাধক। বাউল গুরুরা একাধারে কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও মরমী। তাঁদের গান লোকসাহিত্য মাত্র নয়, বরং বাঙালীর প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। (পৃঃ ২৭১)
এবার আমরা উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কাব্য মধুর মতামত তুলে ধরব। যাঁর সুদীর্ঘ ২০ বছরব্যাপী সাধনার হিরণ্ময় ফসল 'বাংলার বাউল ও বাংলার বাউল গান' (দুই খণ্ড) নামক গ্রন্থ। 'বাংলার বাউল' গ্রন্থে তিনি বলেন,
"বাংলা-সাহিত্যের উদ্যান- কোণে এই জাতি- গৌরবহীন বনফুল বিনম্র সৌন্দর্যে ফুটিয়া তাহার স্নিগ্ধ সৌরভ বিলাইতেছে। সাহিত্য যদি সমাজ-জীবনের দর্পণ হয়, তবে বাঙালী সমাজের এক কোণের একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের ধর্ম-বিশ্বাস, অধ্যাত্ম-চিন্তা, জগৎ ও জীবন-সম্বন্ধীয় মনোভাব, বিভিন্ন ভাবানুভূতি তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছে; বাঙালীর সংস্কৃতি, বাঙালীর ধর্মের অন্তর্ভূঢ় স্রোতধারা, তাহার সাধনার বৈচিত্র্যময় স্বরূপের সম্যক পরিচয় এই পল্লী-সংগীতগুলির সঙ্গে জড়াইয়া আছে।” (পৃঃ ১১০)
বাউল তত্ত্ব ও বাউল গান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগ ছিল। তাঁর বিভিন্ন লেখায় বিষয়টি দীব্যরাগে স্ফুট হয়েছে।
সবশেষে আমরা ড. আহমদ শরীফ এর 'সাহিত্য তত্ত্ব ও বাঙলা সাহিত্য' গ্রন্থে উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি চয়ন করবো,
"(বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এ মিলনে গান জেগেছে। এ গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।” (পৃঃ ২৭৫)
তথ্যসূত্রঃ
ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা, ১৩৬৪।
অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম: বাউল কবি লালন শাহ, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ১৩৭৩।
ড. আহমদ শরীফ
(ক)বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০৫।
(খ) সাহিত্যতত্ত্ব ও বাঙলা সাহিত্য, বিদ্যা প্রকাশ ঢাকা ২০০৪।
শ্রী ভূদেব চৌধুরী: বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, ১ম পর্যায়, দে'জ পাবলিশিং
কলকাতা, ১৯৯৫।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন
হারামণি পঞ্চম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৩৯০।
ড. ওয়াকিল আহমদ:
(ক)বাংলা সাহিত্যের পূরাবৃত্ত, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০০৬।
(খ)বাংলা লোক সংগীতের ধারা, বাতায়ন প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৬।
ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক: মরমি কবি পাঞ্জু শাহ: জীবন ও কাব্য, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ১৯৯০।
(জাহান আরা খাতুন, হবিগঞ্জ)
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan